একজন নারী মাত্র কয়েক লাখ টাকায় বিকোবে কেন

সংগৃহীত ছবি

 

খুজিস্তা নূর ই নাহারিন : বন্ধুত্ব হচ্ছে লেনদেনবিহীন এক সম্পর্ক, যেখানে কোনো প্রত্যাশা ছাড়া একে অপরের শুভ চিন্তক।

 

টিংকু ভাই প্রায় প্রতিদিন আমাকে চিঠি লিখেন। বেশির ভাগ চিঠিই হতাশা, স্বপ্নহীনতা আর বেদনায় নীল।

 

আমি মাঝে মাঝে উত্তর লিখি। কিন্তু ঠিক চিঠির মতো করে লিখি না। আমার মনে অবিশ্বাস জন্মেছে তিনি অন্যদের দেখাবেন প্লাস তার কাছে চিঠি থাকুক, চাই না আমি। রাফ করার জন্য নিউজপ্রিন্টের কাগজ।  সেই কাগজে উত্তর লেখি। বেশির ভাগ চিঠিতেই ফুল-ফল লতাপাতার ছবি আঁকি। এই যেমন ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা এঁকে লিখলাম আমি এখন চা খাচ্ছি, আপনি খাবেন? আপনার মন আজ কেমন আছে? আপনার বাসায় ছোট ভাইয়েরা কী করছে? সেই সময় চলতে থাকা টেলিভিশন সিরিজ নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর কোন সিনটা ভালো লেগেছে, এসব লিখি। এই চিঠিতে প্রেমিকা ভাবার কোনো অবকাশ রাখি না। আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ। যে কেউ দেখলে ভাববে, হয়তো স্কুলের গন্ডি পার হইনি। সম্বোধনে লিখি, শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাই। ইতিতে লিখি- স্নেহের মুন্নি।

 

বিরক্ত হয়ে টিংকু ভাই বললেন, ‘তুমি দেখি ভালো করে চিঠিও লিখতে জানো না। তুমি কি এতই ফকির, তোমার একটি রাইটিং প্যাড কেনারও সামর্থ্য নেই?’ আমি জবাব দিলাম, আমি তো সাহিত্যের ছাত্রী নই, বিজ্ঞানের ছাত্রী। আমি অঙ্ক বুঝি, অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন বুঝি, সমীকরণ বুঝি কিন্তু সুন্দর চিঠি লিখতে পারি না।

 

চিঠির উত্তর দেওয়ার কারণ হচ্ছে, সম্পূর্ণ বিষাদে ডুবে থাকা। মানুষটা যেন কষ্টের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে পারে। আমি তাদের সাহায্য করতে চাই।

 

একদিন বিকালে মাঠে বসে বাদাম খেতে খেতে জানালেন ইকবাল (হুইপ ইকবালুর রহিম) বলেছে, ‘মুন্নির গলাটা রাজহাঁসের মতো অহংকারী, কিন্তু কার্জন হলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই ও আপনাকে বিয়ে করবে না। ইকবাল ভাই আমার অল্প সিনিয়র। দিনাজপুরের তহু, ডেইজীসহ ছোট-বড় আমরা মাঝে মাঝে কলাভবনের মাঠে আড্ডায় মেতে উঠি। আমাদের সম্পর্কটা নিখাদ বন্ধুত্বের।

 

আমি বললাম কী আশ্চর্য! বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? তা ছাড়া আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে। বেইলি রোডে খাবারের দোকানে চটপটি খেতে আপনাদের দেখা গেছে। রিকশার হুড ফেলে হাস্যোজ্জ্বল আপনারা একসঙ্গে সেখানে খেতে গেছেন।

 

টিংকু ভাই খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন, কিন্তু সামলে নিলেন। সেশন জ্যামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে। হলে যারা থাকে, ক্যাম্পাসের মধ্যেই ঘুর ঘুর করে। এখানে সংবাদ পাওয়া মোটেও কষ্টসাধ্য নয়। উপরন্তু আমি মিশুক প্রকৃতির, আমাকে সাবধান করা শুভ চিন্তকের অভাব নেই।

 

আমি ব্যস্ত আমার থিসিস পেপার রেডি করা নিয়ে। টিংকু ভাই বললেন, আনন্দ প্রিন্টার্সে রাব্বানি জাব্বার ভাইয়ের প্রেসে প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছি নটর ডেমের পাশে এখানে আস। বারবার বললাম, দরকার নেই। আমি নিজেই করে নিতে পারব। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা।

 

হঠাৎ একদিন বললেন, আমার বোনরা সবাই ঢাকায়, তুমি ওদের সঙ্গে দেখা করবে মুন্নি? আমি বললাম আমি কেন দেখা করব? তিনি বললেন, তুমি আমার ভালো বন্ধু এ কারণেই না-হয় দেখা করলে। আমি বললাম, ওনারা আমাকে পাত্রী হিসেবে ভাবছেন না তো? তিনি বললেন, ভাবলেই ক্ষতি কী! এটলিস্ট আমার জন্য পাত্রী দেখা বন্ধ হবে। ওরা পাত্রী দেখে দেখে আমার ইজ্জত-সম্মান শেষ করে ফেলছে, সেটা অন্তত বন্ধ হবে। আমি বললাম, আপনার চটপটি খাওয়া গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কি ব্রেকআপ হয়েছে? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড এক, নাকি একাধিক?

 

টিংকু ভাইয়ের পরিবার দেখার আগ্রহ আমারও আছে। যাই, দেখে আসি, অসুবিধা কী। ডাসের সামনে সবাই এসেছে। আমি একটি মাড় ছাড়া ত্যানা সুতির শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম।

 

আম্মা প্রায়ই পাত্র নতুবা পাত্রের পরিবার পাঠায়, তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলা আমার জন্য বাধ্যতামূলক। এ অসম্মানজনক কাজটিকে আমি খুব একটা পাত্তা দিই না। গত আট বছরে এটা আমার অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে বিধায় নতুন কিছু নয়। আম্মাকে অনেক বলেও বোঝাতে পারি না পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করলে রসায়নের মতো কঠিন বিষয় সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। আবার বিয়ের জন্য আম্মা কখনো জোর করেননি, এটাও সত্য।

 

বিকালবেলা টিংকু ভাই দেখা করতে এসেছেন। তিনি আজ পদার্থবিজ্ঞান ভবনের সামনের অল্প উঁচু রেলিংয়ের ওপর বসেছেন, আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আমি বললাম, আপনি কোনো দিন বলেননি, আপনার পরিবারের সবাই বোরকা পরেন। তিনি বললেন, তোমার পরতে হবে না। আমি বললাম, আমার পরিবার কোনো দিন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে মেনে নেবে না। তা ছাড়া আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে, আমি নিশ্চিত।

 

তিনি বললেন, তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। আমি বললাম, আমাকে মেরে কুটি কুটি করে ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দেবে, তবুও আপনার সঙ্গে বিয়ে দেবে না।

 

তিনি বললেন, প্রস্তাব পাঠিয়েই দেখি। আমি বললাম, অহেতুক আমার জীবনটাকে অসহ্য করে ফেলবেন না আপনি। আমাকে ওরা বাসা থেকেই বের হতে দেবে না, জামালপুরেই আটকে রাখবে। আমার আম্মা ভীষণ জেদি আর রাগি, মেরে ফাটিয়ে দেবে।

 

অনেক দিন আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি চট্টগ্রামের ফোন নম্বর পাঠিয়ে বলেছেন, আমি যেন অবশ্যই তাকে টেলিফোন করি। ১৯ সেপ্টেম্বর আমার ভাইভা পরীক্ষা শেষে ফরেন মিনিস্ট্রিতে লায়লা আপার অফিসে যেয়ে ফোন দিয়ে বললাম, কাল সকাল সাড়ে ৭টায় তিস্তা ট্রেনে চেপে জামালপুর চলে যাচ্ছি। টিংকু ভাই বললেন, কালই যাবে কিন্তু টিকিটটা একটু চেঞ্জ করে নাও। সকালে না যেয়ে বিকালে যাও। সকালে আমি ঢাকায় ফিরব আমার বাসায় কোনো দিন আসনি, একবার এসে অন্তত দেখে যাও। অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পেও না বাসায় আমি একা থাকব না। টিটন আর রাজ্জাকও থাকবে। কাজের লোকও আছে।

 

বাসায় যাব একা! কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে কোনো দিন অপ্রীতিকর কোনো আচরণ করেননি। পুটুমণিকে বললাম, আমার সঙ্গে চল। পুটু বলল, ওর আজ মিডটার্ম পরীক্ষা, সঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। সাহস করে বের হলাম সকাল ঠিক ১০টায়। আজ আমার পরনে সাদা একটি সুতির শাড়ি।

 

২৬, পুরানা পল্টনের চারতলা, সেরিনা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে আমি ‘থ’ বনে গেছি। রাজ্জাক, টিটন তো আছেই কিন্তু আরও আছে মগবাজারের কাজি সাহেব। শাহিন ভাই (জাস্টিস ওবাইদুল হাসান শাহিন) আর এনায়েত ভাই (জাস্টিস এম এনায়েতুর রহিম)। বিয়ে পড়ানোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। অথচ কাল ঘুণাক্ষরেও আমায় বলেননি।

 

বিয়ের আয়োজন দেখে আমি স্তব্ধ, কোনো কথা বলতে পারছি না। পাশের রুমে টিংকু ভাই আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন, তুমি আমাকে পছন্দ কর না? আমি বললাম করি। তিনি বলছেন, ভালোবাসো না? আমি বললাম, হয়তো ভালোও বাসি কিন্তু পছন্দ করা আর বিয়ে করা কিছুতেই এক নয়, আমার আব্বা-আম্মা হার্টফেল করবেন। আমি কিছুতেই আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।

 

বললাম আপনার ‘তুমহারি অমৃতা’ দেখতে যাওয়া গার্লফ্রেন্ড কই? বেইলি রোডে চটপটি খেতে যাওয়া গার্লফ্রেন্ড কই? তাদের যেয়ে বিয়ে করেন, আমি কেন?

 

আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। অনুনয় করে বুঝিয়ে বললাম, কয়েক মাস পর বিসিএস পরীক্ষা দিতে ঢাকায় ফিরব। তা ছাড়া সামনের মাসেই আসছি তখন না-হয় আমরা বিয়ে করব।

 

এ মুহূর্তে আমি কিছুতেই তৈরি নই এ বিয়ের জন্য। আমার কান্না শেষ হওয়া মাত্র টিংকু ভাই কান্না শুরু করলেন। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, মুন্নি। আজ তুমি চলে গেলে এক মাস, এক বছর নয়। কোনো দিন আর ফিরে আসবে না, আমি নিশ্চিত জানি।

 

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। বুঝে গেছি বিয়ে না করে বের হতে পারব না কিছুতেই। বাথরুমে ঢুকে কপালের টিপ খুলে আয়নায় লাগালাম, হাতের তালু দিয়ে চোখের কিনারের কাজলটুকু মুছে ফেললাম। কানের ছোট্ট রুপার দুল, হাতে পরা লাল রেশমি চুড়িও খুলে ফেললাম।

 

এ বিয়েতে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নেই, কোনো আনন্দ-উল্লাস নেই। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হইহল্লা, কন্যাদান, উৎসবমুখরতা- কিচ্ছু নেই।

 

সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে বিয়েতে যে সম্মান, আদর, তৃপ্তি আর গুরুত্ব, সবকিছুই এখানে অনুপস্থিত।

 

বিয়ের লাল বেনারসি, দুই হাতে ভরে মেহেদি, গায়ে হলুদ আর পুরো শরীরে তাজা ফুলের মালা নেই। ন্যূনতম একটি নতুন শাড়িও নেই।

 

বিয়ে, আনুষ্ঠানিকতা আর সাজ নিয়ে প্রতিটি মেয়ের অনেক রোমান্টিক স্বপ্ন থাকে। সে স্বপ্নগুলো চোখের সামনে একটি একটি করে ঝরে পড়ছে আর আমি নিঃশব্দে কাঁদছি।

 

বিয়ে মানে বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালোবাসার আশ্রয়। বিয়ে মানে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার। এ বিয়েতে খুশি কই, আনন্দ কই, নির্ভরতা কই, বিশ্বাস আর ভালোবাসাই বা কই?

 

ভবিষ্যৎ জীবনে এত বড় চ্যালেঞ্জ, ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা আর স্বপ্নভঙ্গের অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কেবলই।

 

অজু করে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে বললাম আমি রাজি, কাজি সাহেবকে ডাকুন। ভীষণ খুশি হয়ে হাসি হাসি মুখ করে টিংকু ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কাবিন কত হবে?

 

মনের ভিতরে থাকা অসহায়ত্ব, তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইল। অভিমানকে আড়াল করে ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘এক টাকাও না, আমি আপনাকে মাগনা বিয়ে করব।’

 

কাবিন বা দেনমোহর মানে নারীর মূল্য নির্ধারণ। একজন নারী মাত্র কয়েক লাখ টাকায় বিকোবে কেন? নারীর দাম হবে আকাশছোঁয়া, যা দেওয়ার ক্ষমতা কোনো পুরুষেরই থাকবে না। নারী পুরুষকে মায়া করবে, কখনো দয়া দেখাবে, কখনো-বা কেবলই ভালোবেসে ঘর বাঁধবে।

 

দেনমোহর হবে কেবলই নির্ভরতা, প্রেম, ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা।  যে কোনো বিয়েতে কাবিন নিয়ে দর-কষাকষি পশুর হাঁটের গরু বিকিকিনির মতো মনে হয়। নারী কেবল এক শরীর নয়, এক অমূল্য সত্তাও। বিকিকিনির হাঁটে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সত্তাও যে বিকিয়ে যায়।

লেখক : মানবতাবাদী লেখিকা  ।  সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুই-এক বছর দেখতে চাই : নুর

» চোখের সেবা সম্প্রসারণে অরবিসের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ আগ্রহী : ইউনূস

» ভারতে বসে হাসিনা ষড়যন্ত্র করছেন : এ্যানি

» স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দে ইইউর সমর্থন চাইল বাংলাদেশ

» ধাপে ধাপে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে সরকার : হাসান আরিফ

» বিমান বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা

» অনলাইনে আয়কর পরিশোধ সহজ করতে এনবিআর-এর সাথে পার্টনারশিপ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

» বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় অশনি সংকেত অটোমেশন; ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা

» ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি আলালের

» থানায় এসে কেউ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়: ডিএমপি কমিশনার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

একজন নারী মাত্র কয়েক লাখ টাকায় বিকোবে কেন

সংগৃহীত ছবি

 

খুজিস্তা নূর ই নাহারিন : বন্ধুত্ব হচ্ছে লেনদেনবিহীন এক সম্পর্ক, যেখানে কোনো প্রত্যাশা ছাড়া একে অপরের শুভ চিন্তক।

 

টিংকু ভাই প্রায় প্রতিদিন আমাকে চিঠি লিখেন। বেশির ভাগ চিঠিই হতাশা, স্বপ্নহীনতা আর বেদনায় নীল।

 

আমি মাঝে মাঝে উত্তর লিখি। কিন্তু ঠিক চিঠির মতো করে লিখি না। আমার মনে অবিশ্বাস জন্মেছে তিনি অন্যদের দেখাবেন প্লাস তার কাছে চিঠি থাকুক, চাই না আমি। রাফ করার জন্য নিউজপ্রিন্টের কাগজ।  সেই কাগজে উত্তর লেখি। বেশির ভাগ চিঠিতেই ফুল-ফল লতাপাতার ছবি আঁকি। এই যেমন ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা এঁকে লিখলাম আমি এখন চা খাচ্ছি, আপনি খাবেন? আপনার মন আজ কেমন আছে? আপনার বাসায় ছোট ভাইয়েরা কী করছে? সেই সময় চলতে থাকা টেলিভিশন সিরিজ নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর কোন সিনটা ভালো লেগেছে, এসব লিখি। এই চিঠিতে প্রেমিকা ভাবার কোনো অবকাশ রাখি না। আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ। যে কেউ দেখলে ভাববে, হয়তো স্কুলের গন্ডি পার হইনি। সম্বোধনে লিখি, শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাই। ইতিতে লিখি- স্নেহের মুন্নি।

 

বিরক্ত হয়ে টিংকু ভাই বললেন, ‘তুমি দেখি ভালো করে চিঠিও লিখতে জানো না। তুমি কি এতই ফকির, তোমার একটি রাইটিং প্যাড কেনারও সামর্থ্য নেই?’ আমি জবাব দিলাম, আমি তো সাহিত্যের ছাত্রী নই, বিজ্ঞানের ছাত্রী। আমি অঙ্ক বুঝি, অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন বুঝি, সমীকরণ বুঝি কিন্তু সুন্দর চিঠি লিখতে পারি না।

 

চিঠির উত্তর দেওয়ার কারণ হচ্ছে, সম্পূর্ণ বিষাদে ডুবে থাকা। মানুষটা যেন কষ্টের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে পারে। আমি তাদের সাহায্য করতে চাই।

 

একদিন বিকালে মাঠে বসে বাদাম খেতে খেতে জানালেন ইকবাল (হুইপ ইকবালুর রহিম) বলেছে, ‘মুন্নির গলাটা রাজহাঁসের মতো অহংকারী, কিন্তু কার্জন হলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই ও আপনাকে বিয়ে করবে না। ইকবাল ভাই আমার অল্প সিনিয়র। দিনাজপুরের তহু, ডেইজীসহ ছোট-বড় আমরা মাঝে মাঝে কলাভবনের মাঠে আড্ডায় মেতে উঠি। আমাদের সম্পর্কটা নিখাদ বন্ধুত্বের।

 

আমি বললাম কী আশ্চর্য! বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? তা ছাড়া আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে। বেইলি রোডে খাবারের দোকানে চটপটি খেতে আপনাদের দেখা গেছে। রিকশার হুড ফেলে হাস্যোজ্জ্বল আপনারা একসঙ্গে সেখানে খেতে গেছেন।

 

টিংকু ভাই খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন, কিন্তু সামলে নিলেন। সেশন জ্যামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে। হলে যারা থাকে, ক্যাম্পাসের মধ্যেই ঘুর ঘুর করে। এখানে সংবাদ পাওয়া মোটেও কষ্টসাধ্য নয়। উপরন্তু আমি মিশুক প্রকৃতির, আমাকে সাবধান করা শুভ চিন্তকের অভাব নেই।

 

আমি ব্যস্ত আমার থিসিস পেপার রেডি করা নিয়ে। টিংকু ভাই বললেন, আনন্দ প্রিন্টার্সে রাব্বানি জাব্বার ভাইয়ের প্রেসে প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছি নটর ডেমের পাশে এখানে আস। বারবার বললাম, দরকার নেই। আমি নিজেই করে নিতে পারব। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা।

 

হঠাৎ একদিন বললেন, আমার বোনরা সবাই ঢাকায়, তুমি ওদের সঙ্গে দেখা করবে মুন্নি? আমি বললাম আমি কেন দেখা করব? তিনি বললেন, তুমি আমার ভালো বন্ধু এ কারণেই না-হয় দেখা করলে। আমি বললাম, ওনারা আমাকে পাত্রী হিসেবে ভাবছেন না তো? তিনি বললেন, ভাবলেই ক্ষতি কী! এটলিস্ট আমার জন্য পাত্রী দেখা বন্ধ হবে। ওরা পাত্রী দেখে দেখে আমার ইজ্জত-সম্মান শেষ করে ফেলছে, সেটা অন্তত বন্ধ হবে। আমি বললাম, আপনার চটপটি খাওয়া গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কি ব্রেকআপ হয়েছে? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড এক, নাকি একাধিক?

 

টিংকু ভাইয়ের পরিবার দেখার আগ্রহ আমারও আছে। যাই, দেখে আসি, অসুবিধা কী। ডাসের সামনে সবাই এসেছে। আমি একটি মাড় ছাড়া ত্যানা সুতির শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম।

 

আম্মা প্রায়ই পাত্র নতুবা পাত্রের পরিবার পাঠায়, তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলা আমার জন্য বাধ্যতামূলক। এ অসম্মানজনক কাজটিকে আমি খুব একটা পাত্তা দিই না। গত আট বছরে এটা আমার অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে বিধায় নতুন কিছু নয়। আম্মাকে অনেক বলেও বোঝাতে পারি না পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করলে রসায়নের মতো কঠিন বিষয় সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। আবার বিয়ের জন্য আম্মা কখনো জোর করেননি, এটাও সত্য।

 

বিকালবেলা টিংকু ভাই দেখা করতে এসেছেন। তিনি আজ পদার্থবিজ্ঞান ভবনের সামনের অল্প উঁচু রেলিংয়ের ওপর বসেছেন, আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আমি বললাম, আপনি কোনো দিন বলেননি, আপনার পরিবারের সবাই বোরকা পরেন। তিনি বললেন, তোমার পরতে হবে না। আমি বললাম, আমার পরিবার কোনো দিন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে মেনে নেবে না। তা ছাড়া আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে, আমি নিশ্চিত।

 

তিনি বললেন, তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। আমি বললাম, আমাকে মেরে কুটি কুটি করে ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দেবে, তবুও আপনার সঙ্গে বিয়ে দেবে না।

 

তিনি বললেন, প্রস্তাব পাঠিয়েই দেখি। আমি বললাম, অহেতুক আমার জীবনটাকে অসহ্য করে ফেলবেন না আপনি। আমাকে ওরা বাসা থেকেই বের হতে দেবে না, জামালপুরেই আটকে রাখবে। আমার আম্মা ভীষণ জেদি আর রাগি, মেরে ফাটিয়ে দেবে।

 

অনেক দিন আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি চট্টগ্রামের ফোন নম্বর পাঠিয়ে বলেছেন, আমি যেন অবশ্যই তাকে টেলিফোন করি। ১৯ সেপ্টেম্বর আমার ভাইভা পরীক্ষা শেষে ফরেন মিনিস্ট্রিতে লায়লা আপার অফিসে যেয়ে ফোন দিয়ে বললাম, কাল সকাল সাড়ে ৭টায় তিস্তা ট্রেনে চেপে জামালপুর চলে যাচ্ছি। টিংকু ভাই বললেন, কালই যাবে কিন্তু টিকিটটা একটু চেঞ্জ করে নাও। সকালে না যেয়ে বিকালে যাও। সকালে আমি ঢাকায় ফিরব আমার বাসায় কোনো দিন আসনি, একবার এসে অন্তত দেখে যাও। অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পেও না বাসায় আমি একা থাকব না। টিটন আর রাজ্জাকও থাকবে। কাজের লোকও আছে।

 

বাসায় যাব একা! কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে কোনো দিন অপ্রীতিকর কোনো আচরণ করেননি। পুটুমণিকে বললাম, আমার সঙ্গে চল। পুটু বলল, ওর আজ মিডটার্ম পরীক্ষা, সঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। সাহস করে বের হলাম সকাল ঠিক ১০টায়। আজ আমার পরনে সাদা একটি সুতির শাড়ি।

 

২৬, পুরানা পল্টনের চারতলা, সেরিনা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে আমি ‘থ’ বনে গেছি। রাজ্জাক, টিটন তো আছেই কিন্তু আরও আছে মগবাজারের কাজি সাহেব। শাহিন ভাই (জাস্টিস ওবাইদুল হাসান শাহিন) আর এনায়েত ভাই (জাস্টিস এম এনায়েতুর রহিম)। বিয়ে পড়ানোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। অথচ কাল ঘুণাক্ষরেও আমায় বলেননি।

 

বিয়ের আয়োজন দেখে আমি স্তব্ধ, কোনো কথা বলতে পারছি না। পাশের রুমে টিংকু ভাই আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন, তুমি আমাকে পছন্দ কর না? আমি বললাম করি। তিনি বলছেন, ভালোবাসো না? আমি বললাম, হয়তো ভালোও বাসি কিন্তু পছন্দ করা আর বিয়ে করা কিছুতেই এক নয়, আমার আব্বা-আম্মা হার্টফেল করবেন। আমি কিছুতেই আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।

 

বললাম আপনার ‘তুমহারি অমৃতা’ দেখতে যাওয়া গার্লফ্রেন্ড কই? বেইলি রোডে চটপটি খেতে যাওয়া গার্লফ্রেন্ড কই? তাদের যেয়ে বিয়ে করেন, আমি কেন?

 

আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। অনুনয় করে বুঝিয়ে বললাম, কয়েক মাস পর বিসিএস পরীক্ষা দিতে ঢাকায় ফিরব। তা ছাড়া সামনের মাসেই আসছি তখন না-হয় আমরা বিয়ে করব।

 

এ মুহূর্তে আমি কিছুতেই তৈরি নই এ বিয়ের জন্য। আমার কান্না শেষ হওয়া মাত্র টিংকু ভাই কান্না শুরু করলেন। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, মুন্নি। আজ তুমি চলে গেলে এক মাস, এক বছর নয়। কোনো দিন আর ফিরে আসবে না, আমি নিশ্চিত জানি।

 

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। বুঝে গেছি বিয়ে না করে বের হতে পারব না কিছুতেই। বাথরুমে ঢুকে কপালের টিপ খুলে আয়নায় লাগালাম, হাতের তালু দিয়ে চোখের কিনারের কাজলটুকু মুছে ফেললাম। কানের ছোট্ট রুপার দুল, হাতে পরা লাল রেশমি চুড়িও খুলে ফেললাম।

 

এ বিয়েতে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নেই, কোনো আনন্দ-উল্লাস নেই। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হইহল্লা, কন্যাদান, উৎসবমুখরতা- কিচ্ছু নেই।

 

সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে বিয়েতে যে সম্মান, আদর, তৃপ্তি আর গুরুত্ব, সবকিছুই এখানে অনুপস্থিত।

 

বিয়ের লাল বেনারসি, দুই হাতে ভরে মেহেদি, গায়ে হলুদ আর পুরো শরীরে তাজা ফুলের মালা নেই। ন্যূনতম একটি নতুন শাড়িও নেই।

 

বিয়ে, আনুষ্ঠানিকতা আর সাজ নিয়ে প্রতিটি মেয়ের অনেক রোমান্টিক স্বপ্ন থাকে। সে স্বপ্নগুলো চোখের সামনে একটি একটি করে ঝরে পড়ছে আর আমি নিঃশব্দে কাঁদছি।

 

বিয়ে মানে বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালোবাসার আশ্রয়। বিয়ে মানে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার। এ বিয়েতে খুশি কই, আনন্দ কই, নির্ভরতা কই, বিশ্বাস আর ভালোবাসাই বা কই?

 

ভবিষ্যৎ জীবনে এত বড় চ্যালেঞ্জ, ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা আর স্বপ্নভঙ্গের অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কেবলই।

 

অজু করে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে বললাম আমি রাজি, কাজি সাহেবকে ডাকুন। ভীষণ খুশি হয়ে হাসি হাসি মুখ করে টিংকু ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কাবিন কত হবে?

 

মনের ভিতরে থাকা অসহায়ত্ব, তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইল। অভিমানকে আড়াল করে ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘এক টাকাও না, আমি আপনাকে মাগনা বিয়ে করব।’

 

কাবিন বা দেনমোহর মানে নারীর মূল্য নির্ধারণ। একজন নারী মাত্র কয়েক লাখ টাকায় বিকোবে কেন? নারীর দাম হবে আকাশছোঁয়া, যা দেওয়ার ক্ষমতা কোনো পুরুষেরই থাকবে না। নারী পুরুষকে মায়া করবে, কখনো দয়া দেখাবে, কখনো-বা কেবলই ভালোবেসে ঘর বাঁধবে।

 

দেনমোহর হবে কেবলই নির্ভরতা, প্রেম, ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা।  যে কোনো বিয়েতে কাবিন নিয়ে দর-কষাকষি পশুর হাঁটের গরু বিকিকিনির মতো মনে হয়। নারী কেবল এক শরীর নয়, এক অমূল্য সত্তাও। বিকিকিনির হাঁটে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সত্তাও যে বিকিয়ে যায়।

লেখক : মানবতাবাদী লেখিকা  ।  সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com